গর্ভধারণের পর একজন নারীর দেহে নানারকম পরিবর্তন যেমন লক্ষ্য করা যায় তেমনি বেড়ে যায় তার বাড়তি চাহিদা। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতা্পূর্ণ চাহিদা হচ্ছে তার সঠিক ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা যা কেবলমাত্র সুষম খাবার গ্রহণেই পাওয়া সম্ভব।তাই এসময়ে মায়ের প্রতি সঠিক যত্ন নেয়াটা খুবই জরুরি।কারণ মা যা খাবেন তার পেটের সন্তান তাই পাবে। তাই মা যদি পরিপূর্ণ পুষ্টিকর খাবার না খান তাহলে পেটের সন্তানও অপুষ্টিতে ভুগবে যার পরিণতি হয়তো পারিবারিক বোঝাতে রূপ নিতে পারে, এমনকি মৃত সন্তান প্রসবের মতো বড় ধরণের বিপদের আশঙ্কাও থাকতে পারে।মা সুস্থ থাকলে নিরাপদ প্রসবের মাধ্যমে একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ জাতি উপহার দিতে পারবেন। তাই এই সুস্থ ও সুন্দর আগামী প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য এখনই জেনে নিন গর্ভবতী মায়ের পুষ্টিকর খাবারের তালিকা।
গর্ভকালীন মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন, প্রয়োজনে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা বা ডায়েট চার্ট বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদ দ্বারা যাচাই করে নিবেন। এসময়ে কোন কোন খাবার আপনার ও আপনার সন্তানের জন্য ভালো আর কোন কোন খাবার আপনার ভালো লাগলেও সন্তানের জন্য ভালো না কিংবা কোন কোন খাবার আপনার ও সন্তান উভয়ের জন্য ভালো না তা জেনে নিন। আপনার আশপাশে যারা থাকবে, যারা আপনাকে খাবার গ্রহণে বা প্রস্তুতিতে সাহায্য করবে তাদেরকেও জানিয়ে দিন। কারণ খাবার নির্বাচন ও পরিমাণ নির্ধারণে সবাই একই সাথে আপনার প্রতি যত্নবান হতে হবে।
গর্ভকালে যা খাবেন:
সাধারণ যেসব খাবার গর্ভবতী মায়ের জন্য উপকার তা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এসবের পরিমাণ মায়ের শরীরের ধরণ ও খাবার গ্রহণের হিসেবে তারতম্য হয় বিধায় সেটি ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে নেয়াই শ্রেয়।
কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার
এগুলো শরীরে শক্তি যোগানোর জন্য উপকারী। ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, আলু, চিনি, মিষ্টিওগুড় ইত্যাদিতে শর্করা থাকে।তবে বেশি মাত্রায় এসব খাবেন না, কারণ অতিরিক্ত গ্রহণে অনেকের ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা হতে পারে।
প্রোটিন বা আমিষ এবং ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবার
প্রোটিন গর্ভস্থ শিশুর শরীর ও মষ্তিষ্ক গঠনে এবং ভালো ফ্যাট শক্তির ভালো উৎস। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরিতে ও খাদ্য থেকে ভিটামিন সংগ্রহের জন্য ফ্যাট অপিরহার্য। প্রোটিন থাকে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, বাদাম, শিমের বিচি ইত্যাদিতে।আর চর্বির ভালো উৎস হচ্ছে ঘি, মাখন, তেল, মাংসের চর্বি।
আয়রন বা লৌহ এবং ফলিক এসিড জাতীয় খাবার
আয়রন শরীরের রক্ত বাড়াতে সাহায্য করে। সেই সাথে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলিক এসিডের অভাবে বাচ্চার মস্তিষ্ক ও স্নায়ুরজ্জুতে জন্মগত ক্রুটি দেখা দিতে পারে, তাই এটি শিশুর জন্য অপরিহার্য। লেটুসপাতা, পালংশাক, কমলা ফলিক এসিডের দারুণ উৎস। আর ডিমের কুসুম, ডাল, কলিজা, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ থেকে আয়রনের চাহিদা পূরণ হতে পারে। মায়ের জন্য আয়রনজাতীয় খাবার খুবেই জরুরি।
ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার
নবজাত শিশুর হাড় গঠনের জন্য গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে খাবারে ক্যালসিয়াম বেশি আছে এমন খাদ্য বাগতি দিতে হবে। দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস।
ভিটামিন
রোগ প্রতিরোধ, ক্ষয়পূরণ ও শক্তি বদ্ধিতে সহায়তার জন্য ভিটামিন গর্ভবতী মায়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। এসময় বেশি বেশি ভিটামিন প্রয়োজন। বিশেষ করে ভিটামিন-এ, বি-কমপ্লেক্স, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-কে এবং ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার অবশ্যই খেতে হবে। সবুজ শাকসবজি আর রঙ্গিন ফলমূল এসব ভিটামিন-এ, বি ও সি এর ভালো উৎস। এছাড়া দুধ, ডিম, কলিজাতে প্রচুর ভিটামিন ডি ও কে থাকে।
পানি
রোজ প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। পানির সঙ্গে বিভিন্ন স্যুপ, টাটকা ফলের রসও খাওয়া যেতে পারে।
একজন গর্ভবতীর অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে খাবারের প্রতি বাড়তি যত্ন বেশি প্রয়োজন । প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি সমান অনুপাতে যেন প্রতিটি খাবারে থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তাই যেকোনো প্রয়োজনে বা অবস্থায় অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ মতো খাবার খাওয়া উচিত।
গর্ভকালে যা খাবেন না
সন্তান পেটে ধারণ বিষয়টা মায়ের জন্য খুব আবেগের এবং পৃথিবীর মধ্যে সব চাইতে আনন্দের। তাই মা অনেক সময় এই আনন্দে সন্তানের জন্য বেশি ভালো করতে গিয়ে আসলে একটু সমস্যাই বাঁধিয়ে ফেলেন যার পরিণতিতে দৌড়াতে হয় হাসপাতাল বা ডাক্তার পর্যন্ত।তাই খাওয়ার বেলায় এই সমস্যা এড়াতে নিচে বর্ণিত খাবারগুলো গর্ভবতীর খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে অথবা বুঝে দিতে হবে।
কাঁচাডিম
গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পুষ্টিকর খাবার হিসেবে ডিম রাখতে হবে। কিন্তু সাবধান- কাঁচাডিম খাওয়ানো থেকে বিরত থাকবেন। কাঁচা ডিমে সালমোনেলা নামক একটি ব্যাকটেরিয়া থাকে যা জ্বর, বমিভাব, ডায়রিয়া্র মতো রোগের কারণ হতে পারে।
পনির
নরম পনির যা অপাস্তুরিত দুধ দিয়ে তৈরি তা খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। অপ্রাস্তুরিত দুধে লিসটারিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে যা মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
কাঁচা বা আধাসিদ্ধ মাংস
কাঁচা বা আধাসিদ্ধ মাংস খাওয়ানো যাবেনা। এমনকি প্যাকেটজাত মাংসের খাবার যেমন সসেজ, সালামি, পেপারনি ইত্যাদি খাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন।গর্ভবতী মায়ের জন্য ১৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মাছ, মাংস রান্না করতে হবে।
অপাস্তুরিত ফলের রস
ফ্রেস জুস বা অপাস্তুরিত ফলের রসে ইকোলাই, সালমোনেলা নামক কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকে যা গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সুশি
জাপানিজ এই খাবার অনেকের কাছে খুব প্রিয়।গর্ভবতী মা-কে এই খাবারটি দেয়া যাবেনা। এই সামুদ্রিক মাছে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যা অনেক রোগের কারণ হতে পারে।
কফি
কফিতে ক্লান্তি দূর করে। কিন্তু গর্ভবতী মায়ের জন্য এটি বেশি খেলে ক্ষতি হতে পারে। কফিতে ক্যাফেইন নামক উপাদান থাকে যা অতিরিক্ত গ্রহণ করার ফলে মিসক্যারেজের মতো ঘটানাও ঘটতে পারে। তাই এসময়ে কফি একদম কমিয়ে দিতে হবে, না খেলেই ভালো। প্রয়োজনে এক-আধটু রং চা বা লাল-চা খাওয়া যায়।
ধূমপান বা মদ্যপান
এগুলো স্বাভাবিক অবস্থাতেই নিষেধ, আর গর্ভকালে তো আরো না।এমনকি গর্ভাবস্থায় ধূমপান বা মদ্যপানের কাছে থাকাও ঠিক না। কারণ পরোক্ষ ভাবেও তা শরীরে প্রবেশ করে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এগুলো আপনার আনাগত সন্তানের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন- ব্রেইন, নার্ভ ইত্যাদি তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে।অ্যালকোহল আছে এমন খাবারও এসময় বাদ দিন।
অপাস্তুরিত বা কাঁচাদুধ
অপাস্তুরিত বা কাঁচাদুধ অথবা কাঁচাদুধের তৈরি খাবার খাওয়াবেন না। দুধ ভালোভাবে ফুটিয়ে তারপর তা পান করতে দিন যাতে এর ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।
কাঁচা বা আধাপাকা পেঁপে ও আনারস
কাঁচা বা আধাপাকা পেঁপে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ক্ষতিকর। কাঁচাপেঁপেতে ল্যাকট্রিক্স নামক উপাদান আছে যা গর্ভপাতের মত ঘটনা ঘটাতে পারে। সেই সাথে আনারসের মধ্যে থাকে ব্রোমেলিন যা গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
বাদাম
বাদাম অ্যালার্জির সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে গর্ভাবস্থায় বাদাম খেলে শিশুর অ্যালার্জি হওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে।
আঙ্গুর
গর্ভকালীন অবস্থায় আঙ্গুর খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। আঙ্গুর পেটকে গরম করে হজমে ঝামেলা পাকিয়ে ডারিয়ার মতো রোগ ঘটাতে পারে। তাই এটি থেকে বিরত থাকুন।
মধু
গর্ভাবস্থায় মধু ক্লস্ট্রিডিয়াস্পোর দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে যা বাচ্চাদের খাবারে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাংগর্ভাবস্থায় মধু না খাওয়াই ভালো। এমনকি শিশু জন্মের পরও মধু মিশ্রিত পানি দিতে নিষেধ করা হয়।
গর্ভাবস্থায় খাদ্যাভ্যাসে বা খাদ্য তালিকার যেকোনো খাবার গ্রহণ বা বর্জনের পূর্বে অথবা সঠিক ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ জানতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে ভালো।