মাতৃত্ব প্রতিটি নারীর জীবনেই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিশোরী একটি মেয়ের বয়:সন্ধি কালই তাকে জানান দেয় তার মা হবার যোগ্যতার কথা। এরপর বয়স বাড়ার সাথে তার পরিপক্কতা বাড়ে, মানিসকভাবে প্রস্তুত হয় এবং আর্থিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একসময়ে বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে তার মাতৃত্বে পূর্ণতা পায়। তাই বলে একজন নারী যতো বেশি সন্তানের মা হবে ততো বেশি যোগ্যতার অধিকারী হবে তা নয়। প্রকৃতপক্ষে আদর্শ মা তিনিই যিনি একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তানের জন্ম দিবেন এবং তাকে সঠিকভাবে মানুষ করতে পারবেন।
আর সেই আদর্শ মা হবার জন্য গর্ভধারণের প্রথম দিন থেকেই তাকে সবকিছু বেশ ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে হবে। কারণ এই সময়টাতে মা যা করেন এবং যা খান তার প্রভাব অনাগত সন্তানের উপরই পড়ে। এমনকি মা যা ভাবেন ও চিন্তা করেন তার প্রতিফলনও সন্তানের চিন্তা বা বিকাশের উপর পড়ে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত। তাইতো, গর্ভধারণে থেকে সন্তানের ২ বছর বয়স পর্যন্ত ১০০০ দিনটিকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। বলা হয় এটিই জীবনের মূল ভিত্তি।
তাই এই সময়ে আপনি কী করবেন, কী খাবেন, কী পরবেন, কোথায় যাবেন, কতটুকু খাবেন, কী ভাববেন, কিভাবে ঘুমাবেন, কী করতে পারবেন আর কী করতে পারবেন না সবই জানতে হবে্, সবই মানতে হবে। কিসে আপনার ও আপনার অনাগত ছোট্ট সোনামণিটার জন্য উপকার হবে
আর কিসে ক্ষতি হবে সবই খেয়াল রাখতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শতো আছেই, প্রয়োজনে স্বাস্থ্যকর্মী, মা হয়েছেন এমন কেউ, নিকট আত্মীয় যিনি আপনার ভালো চান এমন কারও পরামর্শ গ্রহণ করবেন। তাহলে আপনি আগে থেকেই সতর্ক ও সচেতন হতে পারবেন যাতে আপনার ভেতরে থাকা আপনার আদরে টুকরো পৃথিবীতে আসতে পারে বেশ সুন্দর ও হাসিখুশি ভাবে।
মা হবার পর কী কী করণীয় তা নিয়ে আলোচনা আমরা পরবর্তীতে করবো, তার আগে চলুন দেখে নিই কিভাবে নিশ্চিত হবে যে আপনি মা হতে চলেছেন, আপনি গর্ভধারণ করেছেন। এর জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করানো। আপনার ভেতরে ভ্রুণের জন্ম হলে আপনার শরীর তা নানাভাবেই জানান দিবে। প্রথমত: আপনার নিয়মিত মাসিকে তার প্রভাব আসবে, তা বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া আরও কিছু আলামত দেখে আপনি সহজেই বুঝে নিতে পারবেন যে আপনার ভিতরে একটু একটু করে জন্ম নিচ্ছে আপনারই আরেকটি সত্তা। যেমন-
মাসিক বন্ধ:
গর্ভধারণের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে নিয়মিত মাসিক বন্ধ হওয়া। এক্ষেত্রে অনেকের অনেক ধরনের সমস্যা বা সংকোচ থাকলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত। কারণ অনেকের গর্ভধারণের পরও অনিয়মিত মাসিকের জন্য বা অন্য কোনো কারণে কিছুটা রক্তক্ষরণ হতে পারে, সেটা অবহেলা করা উচিত না।
খাবারে অনীহা :
খুবই পরিচিত লক্ষণ। আগে যা খেতেন এখন তা বিস্বাদ লাগতে পারে। এজন্য দেখা যায় অনেকে টক বা তেঁতুল খেয়ে রুটি আনার চেষ্টা করেন।
তলপেট ফাঁপা :
দেহের ভিতর আরেকটি দেহ তৈরি হওয়ায় অনেকের হরমোনজনিত কারণে এরকম মনে হতে পারে।
ঘন প্রস্রাব :
হরমোনের পরিবর্তনের আরেকটি প্রভাব হচ্ছে গর্ভধারণের পর কিডনিতে রক্ত প্রবাহ বেড়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে বাড়তি জলীয় অংশে কিডনি দ্রুত ভরে যায় ও ঘনঘন প্রসাবের বেগ পায়। সময়ের সাথে এই প্রভাব বাড়তে থাকে।
ক্লান্তি :
প্রজেস্টেরন বৃদ্ধির কারণে এই সময়ে অল্পতেই ক্লান্ত অনুভব করতে পারেন। গর্ভকালীন সময়ে সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ক্লান্তি (একে বলে ‘মর্নিং সিকনেস’) ও বমিভাব হতে পারে। রাতে ঘনঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণেও ক্লান্তি বেড়ে যায়। তাছাড়া আপনার শরীরের যাবতীয় কার্যক্রমে এখন আরেকটি শরীর চলছে, তাই স্বভাবতই সাভাবিকের চেয়ে আপনার শক্তি বেশি খরচ হচ্ছে। এজন্যই আপনাকে পরিমিত খাবার ও বিশ্রাম নিতে হবে।
স্তন স্ফীত হওয়া:
সৃষ্টিকর্তার এক অপার মহিমা হচ্ছে একটি শিশু পৃথিবীতে আসার আগেই মায়ের বুকে তার জন্য উপযুক্ত ও সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ খাবারটি তৈরি করে রাখা। আজ পর্যন্ত শিশুদের জন্য মায়ের দুধের সমকক্ষ বা এর বিকল্প কোনো খাবার তৈরি হয়নি এবং তা হবেও না। যা হয়েছে তা কেবল শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ ফর্মুলা বা শিশুখাদ্য বিশেষ। গর্ভধারণের পরবর্তী মাসগুলোতে শরীরে ধীরে ধীরে হরমোনের পরিবর্তনের সাথে সাথে বুধের স্তনেও পরিবর্তন আসা শুরু করে। ভেতরের শিরা-উপশিরা বা নালীতে সন্তানের জন্য দুধ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাই স্তনও আস্তে আস্তে স্বাভাবিকের চেয়ে ফুলতে থাকে।
বমিভাব :
গর্ভধারণের পর ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর থেকে মর্নিং সিকনেস দেখা দিতে পারে যা হলো সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ক্লান্ত লাগা ও বমিভাব হওয়া। এটা সকাল ছাড়াও সকাল-বিকালও দেখা যেতে পারে। তবে গর্ভধারণের ১২-১৬ সপ্তাহ পরে বমিভাব সাধারণত অনেকটাই কমে যায়।
পিঠে ব্যথা বা ব্যাক পেইন:
পেটের ভেতরেরর শিশুটি বড় হবার সাথে সাথে কোমড় বা পিঠের নানা অংশে ব্যথা অনুভব হতে পারে। এটি স্বাভাবিক, তবে অতিরিক্ত হলে বা বেশি খারাপ লাগলে অবশ্যই ডাক্তারের শরনাপন্ন হবেন
মুড চেঞ্জ বা মানসিক পরিবর্তন:
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে জীবনের এই সময়ে নানা কিছুই মাথায় আসে, তাছাড়া শরীরের ভেতরকার এই পরিবর্তণের একটি প্রভাব মনেও আসে। তাই এসেময়ে মুড খুব দ্রুত বদলায়, মানসিক অবস্থার যথেষ্ট তারতম্যের সষ্টি হয়। আর সেজন্যই সবসময়ই মুড ঠিক রাখতে কিছু না কিছু ভালো চিন্তা, বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি করা হয়। এক্ষেত্রে স্বামীর একটি বড় ভূমিকা থাকে, স্ত্রীর সাথে ভালো গল্প করলে, তাকে সময় দিলে, সন্তান একটু আশার স্বপ্ন দেখলে মায়ের মনটা অনেকখানিই ভালো হয়ে যায়।
তবে যাই হোক না কেন, গর্ভাবস্থাকে কোনোভাবেই অবহেলা করবেন না। একটু ভুলের জন্য আপনার সন্তান তো আছেই, আপনি নিজেও বিপদে পড়ে যেতে পারেন। তাই এসময়ে নিয়মিত ডাক্তারের চেক-আপ খুবই জরুরি। আপনার মাতৃত্বের সূচনা সুন্দর ও নিরাপদ হোক এটাই আমাদের কামনা।