অনেক বাচ্চাই শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানিতে কষ্ট পায়। এক হিসাবে দেখা গেছে, ছেলেদের ১০-১৫ শতাংশ এবং মেয়েদের ৭-১০ শতাংশ এ রোগে ভোগে। জীবনের প্রথম বছরের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং চার-পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ হাঁপানি রোগের প্রকাশ ঘটে। হাঁপানি রোগের সূচনা এবং প্রকাশের সব কারণ বেশ জটিল।
শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা Asthma বা হাঁপানি মূলত শিশুদের জন্য সর্বাধিক দৃশ্যমান শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা। বেশির ভাগ শৈশবকালীন হাঁপানি শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা ১ থেকে ৫ বছর বয়সে দেখা যায়। দুর্ভাগ্যবশত এই সমস্যার স্থায়ী চিকিৎসা হোমিওপ্যাথি হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই বিষয়টি জানেন না আবার যারা জানেন তারা যথা সময়ে অভিজ্ঞ একজন হোমিও চিকিৎসক নির্বাচন করতে ব্যর্থ হন মূলত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্র সম্পর্কে তাদের কোন বাস্তব ধারণা বা জ্ঞান না থাকার কারণে।
বর্তমান বিশ্বে হোমিওপ্যাথি ছাড়া শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমা সমস্যা নির্মূলের স্থায়ী কোন চিকিৎসা নেই। অন্যান্য চিকিৎসা শাস্ত্রে মূলত সমস্যাটি কমিয়ে রেখে আরাম দেয়ার চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে যার কারণে সাময়িক আরাম পেলেও দিন দিন রোগ জটিলতা বাড়তে থাকে এবং দীর্ঘকাল ব্যাপী নানা প্রকার রাসায়নিক ঔষধ শরীরে প্রয়োগ করার ফলে আরো দুরারোগ্য জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
অ্যাজমা Asthma! কারণ, লক্ষণ এবং হাঁপানি থেকে মুক্তির উপায়
শিশুদের শ্বাসনালীগুলো খুবই ক্ষুদ্র। ২ মি. মি. থেকে ৫ মি. মি. ব্যাসবিশিষ্ট। চারদিকে মাংসপেশি পরিবেষ্টিত। এই ক্ষুদ্র শ্বাসনালীর ভেতর দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় খুব সহজেই বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে। যদি কখনও এলার্জিক বা উত্তেজক কোন জিনিস শরীরে প্রবেশ করে তখন শ্বাসনালীর মাংস পেশিগুলো সঙ্কুচিত হয়। ফলে শ্বাসনালী সরু হয়ে যায়। তাছাড়া উত্তেজক জিনিসের প্রভাবে শ্বাসনালীর গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় আঠালো কফ, আর ইনফেকশনের কারণে শ্বাসনালীর ভেতরের দিককার মিউকাস আবরণী আঠালো কফ উঠিয়ে ফেলার লক্ষ্যে অনবরত কাশি হয়ে থাকে। কখনও কখনও এই শ্বাসনালী এত সরু হয় যে, বাতাস বায়ুথলিতে পৌঁছায় না, তখন শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়। এটা খুবই মারাত্মক অবস্থা। এ অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু ঘটতে পারে।
হাঁপানি বা অ্যাজমা – প্রকারভেদ
☐ একিউট অ্যাজমা : তীব্র হাঁপানি এতে ফুসফুসের বায়ুবাহী নালীসমূহ আকস্মিকভাবে সংকুচিত হয় ও শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্টের সৃষ্টি করে।
☐ ক্রনিক অ্যাজমা : দীর্ঘমেয়াদী হাঁপানি এতে ঘন ঘন অ্যাজমায় আক্রান্ত হয় এবং রোগ নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিরোধে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।
শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমা – লক্ষণ
অ্যাজমা শিশুদের উপসর্গ একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়ে থাকে। আপনার শিশু অ্যাজমায় আক্রান্ত কিনা সেটা কিছু উপসর্গ দেখে বুঝতে পারবেন –
☐ শ্বাসত্যাগের সময় প্রতিনিয়ত বাঁশির মতো শব্দ
☐ সব সময় অথবা বারে বারে কাশি লেগে থাকে
☐ শ্বাসকষ্ট এবং ঘন ঘন ঠান্ডা লাগা, যা প্রায়ই বুকে বসে যায়
☐ রাতে শোবার বেলায় বা ভোরের দিকে কাশি বা শ্বাসকষ্টের আওয়াজ
☐ রাতে ঘুম থেকে ওঠে বসে থাকা
☐ বারবার শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছে এবং শাঁ শাঁ শব্দ
☐ বুকে আঁটসাঁট বা দম বন্ধ ভাব
☐ ধোঁয়া, ধুলোবালি, ফুলের রেণু বা পোকামাকড়ের উপস্থিতিতে সমস্যাগুলো বেড়ে যায়
শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমা – কারণ
উপরি উপরি চিন্তা করে দেখা যায় শিশুদের ক্ষেত্রে ৮০% এর বেশি অ্যাজমা হলো এলার্জিজনিত। তবে আরো গভীরে গিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় মানুষের মধ্যে বিদ্যমান প্রকৃত কিছু রোগ যেগুলি মূলত নানা প্রকার জটিল উপসর্গ তৈরী করে থাকে। শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমা হলো তেমনি একটি প্রকৃত রোগের সৃষ্ট উপসর্গ। তবে কিছু কিছু কারণ রয়েছে যেগুলি হাঁপানি সমস্যাটিকে ত্বরান্বিত করে থাকে যেমন –
☐ হাঁপানি বা অ্যালার্জির পারিবারিক ইতিহাস
☐ ভাইরাল ইনফেকশন
☐ লোমশ প্রাণী (যেমন বিড়াল, কুকুর)
☐ সিগারেট বা কাঠের ধোঁয়া
☐ ঘরের জাজিম, বালিশ বা কার্পেটের ধুলোবালি
☐ পুষ্পরেণু ও পোকামাকড় (যেমন তেলাপোকা)
☐ তাপমাত্রার পরিবর্তন
☐ অ্যারোসল বা সুগন্ধী সামগ্রী
☐ অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ
শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমা – কারা আক্রান্ত হতে পারে
যেসব শিশুদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে অ্যালার্জির ইতিহাস আছে এবং যাদের অ্যালার্জিজনিত হাঁপানি বা চর্মরোগ আছে, তাদের হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে এমন নয় যে, হাঁপানি বা পারিবারিক ইতিহাস ছাড়া কোনে শিশুর অ্যাজমা হবে না। বরং ইদানীং এ ধরনের শৈশবকালীন হাঁপানি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
শিশুর হাঁপানি প্রতিরোধে কিছু করণীয়
১. বাতাসের মধ্যে ভাসমান অ্যালার্জি থেকে বাঁচা
* শুধু করোনা মহামারির সময়ে নয়, সব সময় রাস্তা, বাজার ও বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মুখোশ পরার অভ্যাস করুন, উৎসাহ দিন। বিশেষ করে ঢাকার বিষাক্ত বাতাসে চলাফেরায় মুখোশ পরা অনেক ধরনের রোগ থেকে সুরক্ষা দেবে।
* ঘরে মশার কয়েল/স্প্রে ব্যবহার করবেন না (অন্তত শিশুর ঘরে)। মশারির ব্যবহার বাড়ান। দরজা জানালায় জাল (নেট) লাগাতে পারেন।
* ধূমপান পরিহার করুন। শিশুদের পরোক্ষ ধূমপানের হাত থেকে বাঁচান। ধূমপানের আধা ঘণ্টা পরও শ্বাস থেকে নিকোটিন কামরায় ছড়াতে পারে।
* শীতকালে কম্বল ব্যবহার না করে কভারসহ লেপ ব্যবহার করবেন। কম্বলের সূক্ষ্ম আঁশ শ্বাসনালিতে সমস্যা করে।
* আঁশযুক্ত খেলনা, কার্পেট, কুশন পরিহার করবেন।
* ঘর ঝাড় দেওয়ার সময় বাচ্চাকে সরিয়ে রাখুন।
* গ্রামের ফসল তোলার সময়টাও হাঁপানির জন্য খারাপ। ফুলের রেণু, ফসলের আঁশ শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে।
২. খাবারের অ্যালার্জি থেকে বেঁচে থাকুন
* মায়েদের অভিযোগ, চিকিৎসকের কাছে অ্যালার্জির জন্য গেলে মোটা দাগে মজার সব খাবার বাদ দিতে বলেন। সব বাদ না দিয়ে কোনো বিশেষ খাবারে অ্যালার্জি আছে কি না, তা বের করতে হবে। একই খাবারে সবার সমস্যা না-ও হতে পারে। প্রমাণিত অ্যালার্জিযুক্ত খাবার (গরুর মাংস, গরু-ছাগলের দুধ, ইলিশ, চিংড়ি, বেগুন, পুঁইশাক, হাঁসের ডিম ইত্যাদি)। যেকোনো একটি খুব অল্প পরিমাণে দিয়ে দেখতে হবে, সমস্যা হচ্ছে কি না। সমস্যা হলে ওই বিশেষ খাবার বাদ দিতে হবে। সমস্যা না হলে সতর্কতার সঙ্গে খাওয়া যেতে পারে। লক্ষ রাখবেন, একাধিক অ্যালার্জিযুক্ত খাবার একই দিন না দেওয়াই ভালো। রক্ত পরীক্ষা করেও কোন কোন খাবারে অ্যালার্জি হতে পারে, সেটা বের করা যায়।
* কৃত্রিম রংযুক্ত খাবার (প্যাকেটের জুস, চকোলেট, চিপস, সস), ফাস্ট ফুড, ক্ষতিকর রাসায়নিকযুক্ত (ফরমালিন, কার্বাইড ইত্যাদি) ফল, সবজি পরিহার করবেন।
* টাটকা দেশি মৌসুমি ফল (আম, জাম, পেয়ারা, আমড়া, লেবু, কামরাঙা, কলা, কমলা, পেঁপে, গাব, সফেদা, আতা, লটকন, আমলকী ) বেশি করে খাওয়ার অভ্যাস করুন।
* আগে কোনো ওষুধে প্রতিক্রিয়া হলে নোট করে রাখুন এবং চিকিৎসককে জানান।
৩. শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে জোর দিন
* টিভি, মুঠোফোন, ট্যাব দেখা কমিয়ে ঘরের বাইরে খেলাধুলা, হাঁটাহাঁটির চেষ্টা করুন। শহরের বাচ্চারা ছাদেও খেলাধুলা করতে পারে।
* বাচ্চাদের জন্য জন্মের প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ পান করাতে হবে। এরপর ঘরে তৈরি পরিপূরক খাবারের অভ্যাস করুন। কৌটার দুধ, গরু-ছাগলের দুধ, প্যাকেটের সিরিয়াল—এগুলো অ্যালার্জি বাড়াতে পারে।
* নিয়মমতো টিকা দিন।
* ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দিন। হাত পরিষ্কার রাখা ব্যাপারটিই অনেক জীবাণু থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
* বাজারে, রাস্তায় অনেক সময় শ্বাসকষ্ট ‘নির্মূলের’ টোটকা চিকিৎসা দেওয়া হয়, যেখানে উচ্চমাত্রার হাঁপানির ওষুধ এবং অনেক ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ রাসায়নিক থাকে। এগুলো সাময়িক ভালো লাগার অনুভূতি দেয়। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য এগুলো ভয়ংকর ক্ষতির কারণ। ফলে এসব গ্রহণ করা যাবে না।
শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমা – চিকিৎসা
মূলত এই হাঁপানি সমস্যার জেনেটিক মেটেরিয়ালস শিশু জন্ম থেকেই নিয়ে আসে তাদের পূর্বপুরুষ থেকে। হোমিওপ্যাথিতে দুরারোগ্য রোগের কারণ হিসেবে True Disease বা প্রকৃত রোগকে দায়ী করা হয়ে থাকে সেগুলির মধ্যে হাঁপানি বা অ্যাজমা সমস্যার পেছনে মূলত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী থাকে Tubercular Diathesis. এছাড়া রয়েছে Post Trauma Syndrome (PTS) And Post Rabies Syndrome (PRS). হোমিওপ্যাথি মূলত মানুষের ভেতরে থাকা True Disease বা প্রকৃত রোগটির চিকিৎসা দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমাসহ সকল রোগ-ব্যাধি নির্মূল হয়ে শিশু প্রকৃত সুস্বাস্থ্য লাভ করে থাকে।
তবে এর জন্য অভিজ্ঞ একজন হোমিও চিকিৎসক – শিশুর নিজের, তার পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানীর হিস্ট্রি নিবেন এবং তার মধ্যে থাকা প্রকৃত রোগটি নির্ণয় করে সেটিকে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য হোমিওপ্যাথির নির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুযায়ী ডাইনামিক হোমিও মেডিসিন প্রয়োগ করবেন এবং ধাপে ধাপে সামনে আগাবেন। ধৈর্য্য ধরে চিকিৎসা নিলে একসময় দেখবেন হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমার সমস্যা স্থায়ীভাবে নির্মূল হয়ে গেছে ইনশা-আল্লাহ।
পরামর্শ
বাচ্চা স্কুলে গেলে তার হাঁপানির সমস্যা শিক্ষককে জানান, বাচ্চার হাঁপানির লক্ষণগুলো নিয়ে শিক্ষকের সাথে আলোচনা করুন। স্কুলে বা ভ্রমণকালে বাচ্চার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সাথে রাখুন। বাচ্চাকে সবসময় পরিষ্কার থাকতে উৎসাহিত করুন। ওকে ধুলোবালি, জীব-জন্তু, কম্বল, কার্পেট, লোমশ খেলনা দিয়ে খেলতে বারণ করুন, ঝাঝাল গন্ধ যুক্ত আতর, সেন্ট, স্প্রে, রং ওর কাছে দিবেন না।